 
                        ভূমিকা :
                            চিতল একটি সুস্বাদু ও জনপ্রিয়  মাছ। চিতল মাছের কোন্তার কোন জুড়ি নেই। চাহিদা এবং স্বাদের জন্য এই মাছের দানার মূল্য অনেক বেশি। একসময় বাংলাদেশের নদীতে, বিলে, হাওরে প্রচুর পরিমানে চিতল মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু চিতল আজ বিপন্ন প্রায় বিলুপ্তির হাত থেকে চিতলকে রক্ষার প্রধানত উপায় হলো সঠিকভাবে এর ব্রড ব্যবস্থাপনা এবং কৃত্রিম অথবা নিয়ন্ত্রিত প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করা। চিতল একটি রাক্ষুসে মাছ। বছরে কয়েকবার পোনা উৎপাদনে সক্ষম,তেলাপিয়া মাছের সাথে চিতল মাছ চাষ করলে পুকুরে তেলপিয়ার অনাকাঙ্খিত পোনা নিয়ন্ত্রন করে চিতলের পাশাপাশি তেলাপিয়ারও কাঙ্খিত উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব। তেলাপিয়া ছাড়াও মলা, ঢেলা, চাদা, ছোট চিংড়ি, চাপিলার সাথে সহজেই চিতল চাষ করা যায়। চিতল মাছ রাতের বেলায় বেশি সক্রিয় থাকে এবং শিকার করে। তবে দিনের বেলায় সাধারণত তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে। রাক্ষুসে স্বভাবের হলেও চিতল চাষযোগ্য মাছ। ইহা ৭-৮ সে.মি (৩ ইঞ্চি) এর অধিক বড় আকারের মাছ শিকার করতে পারে না অর্থাৎ বড় আকারের কোন মাছের জন্য চিতল ক্ষতিকর নয়।
                            
                            ডিম পাড়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ এবং অবলম্বন ছাড়া চিতল মাছ ডিম দেয় না। প্রকৃতিতে সাধারণভাবে সাবসট্রেট পাওয়া দূরহ। চিতল মাছের একসাথে অধিক পোনা পাওয়া কঠিন। এছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশে পোনার মৃত্যুর হার অত্যাধিক। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এক পর্যয়ে নিজেরাই নিজেদের পোনা খেতে শুরু করে। প্রকৃতিতে চিতল মাছকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনতে হলে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে একসাথে অধিক পোনা উৎপাদনের বিকল্প নেই।
                            
                            ব্রুড মাছ প্রতিপালনের জন্য পুকুর নির্বাচন : চিতল মাছের ব্রুড প্রতিপালনের জন্য সারা বছর পানি থাকে এরকম পুকুর নির্বাচন করতে হবে। ২০-৩০ শতাংশ বা তার চেয়ে বড় আয়তনের পুকুর ব্রুড প্রতিপালনের উপযোগী এবং পানির গড় গভীরতা ৪-৬ ফুট থাকা বাঞ্ছনীয়। পুকুর পাড়ে বড় বড় গাছ-পালা না থাকা ভালো। গাছ-পালা থাকলে পাতা পড়ে পুকুরের পানি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং সূর্যালোকের অভাবে পুকুরে উৎপাদনশীলতাও কমে যায়।
                            
                            ব্রুড মাছ প্রতিপালন :
                            
                            ব্রুডমাছ প্রতিপালনের উপর কৃত্রিম প্রজননের সফলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। সাধারণত চিতল মাছ ৩ বছর বয়সে প্রজননক্ষম মাছে পরিণত হয়। ব্রুডমাছ প্রতিপালনের জন্য পুকুর প্রস্তুতি অন্যান্য ব্রুড মাছের ন্যায় করতে হয়। তবে মাছ মজুদের পর যাতে খাদ্যাভাব দেখা না দেয় সেজন্য ব্রুড চিতল মজুদের কমপক্ষে ১৫ দিন পূর্বে প্রাপ্তবয়স অটোস্টকিং তেলাপিয়া প্রতি শতাংশে ৫০ জোড়া স্ত্রী এবং পুরুষ মাছ মজুদ করে রাখতে হয়। কৃত্রিম প্রজননের জন্য সুস্থ সবল পূর্ণ বয়স্ক মাছ নির্বাচন করে একর প্রতি ৩০০-৪০০ কেজি মাছ মার্চ মাসের মধ্যে পুকুরে মজুদ করতে হবে। পুকুরে পানি বদল মাছকে ডিম দিতে উত্তোজিত করে। এজন্য ব্রুড প্রতিপালন পুকুরে, প্রতিদিন কমপক্ষে ২/১ ঘন্টা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা উত্তম। প্রজননক্ষম মাছকে অযথা বিরক্ত না করাই শ্রেয়। মজুদ পরবর্তী সময়ে মাছের শরীরে আঘাতজনিত কারণে কোন দাগ দেখা দিলে পুকুরে শতাংশ প্রতি ২৫০ গ্রাম লবন এবং ২০ গ্রাম ফিটকারী ১ দিন অন্তর অন্তর ৭ দিন পর্যন্ত প্রয়োগ করতে হবে। মাছ মজুদের পর জীবিত মলা, ঢেলা, চান্দা, ছোট চিংড়ি, চাপিলা সম্পূরক খাদ্য হিসাবে মজুদকৃত মাছের দেহ ওজনের ১-২% হারে সপ্তহে ১-২ বার সরবরাহ করা উত্তম
                            প্রজননক্ষম মাছ সনাক্ত ও বাছাইকরণ :
                            
                            আবহাওয়ার তারতম্য ভেদে এবং সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগের ওপর চিতল মাছের প্রজনন নির্ভর করে। সাধারণত মে থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত চিতল মাছ প্রজনন করে থাকে। তবে জুন মাস সর্বোচ্চ প্রজননকাল। প্রজনন মৌসুমে মাছ পরীক্ষা করে প্রজননক্ষম মাছ নির্বাচন করতে হবে। প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী মাছের পেট ডিমে ভর্তি ও ফোলা থাকে। এছাড়া স্ত্রী মাছের জননেন্দ্রিয় গোলাকার, লালচে এবং ফোলা থাকে। পরিপক্ক পুরুষ চিতল মাছের পেট চ্যাপ্টা এবং জননেন্দ্রিয় লম্বাকৃতির হয়ে থাকে।
                            
                            পুকুর প্রস্তুতকরণ :
                            
                            প্রজনন পুকুর ১০-১৫ শতাংশের হলে ভাল হয়। একটি পুকুরে ১০-১৫ টি সাসট্রেট দেয়া ভাল। সাবসট্রেটগুলো সিমেন্টর স্লাব, বড় আকারের পাথর ও ইট হলে ভালো তবে চ্যাপ্টা কাঠের উপরও চিতল ডিম দেয়। কিন্তু মসৃণ বাঁশ সাবসট্রেট হিসাবে চিতলের পছন্দীয় নয়। হরমোন প্রয়োগের পর প্রজননের জন্য মাছ মজুদের পর যাতে খাদ্যভাব না দেখা দেয় সেজন্য ব্রুড প্রতিপালন পুকুরের ন্যায় প্রজনন পুকুরেও পর্যাপ্ত জীবিত ছোট মাছ সরবরাহ করতে হবে। খাদ্যাভাব হলে মাছ শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে মাছ প্রজনন ক্রিয়ায় অংশ নিলেও প্রাপ্ত ডিমের গুণগত মান সন্তোষজনক হয় না। এ ছাড়া ডিম দিতে সময় বেশি নিতে পারে বা মাছ ডিম নাও দিতে পারে। পুকুরে মাটির কাছাকাছি সাসট্রেট বাঁশের পুলের সাথে ঝুলিয়ে দিতে পারলে ডিম পর্যবেক্ষণ করা সহজ হয়।
                            
                            কৃত্রিম প্রজনন :
                            
                            সাধারণত মে থেকে আগস্ট মাসে পূর্ণিমা এবং অমাবস্যার পর চিতল ডিম দিয়ে থাকে। তবে চিতল মাছকে পিটুইটারী গ্রন্থি (পিজি) হরমোন দিয়ে কৃত্রিমভাবে প্রজনন করানো যায়। পোনা উৎপাদনের জন্য শুধুমাত্র স্ত্রী মাছকে প্রতি কেজি ওজনের জন্য ১১ মি.গ্রাম হারে মাছের পার্শ্বীয় পাখনার নীচের মাংসে ৪৫° কোণে একবার পিটুইটারী (পিজি) দ্রবণের হরমোন ইনজেকশন আকারে প্রয়োগ করতে হয়। হরমোন প্রয়োগের পর স্ত্রী এবং পুরুষ মাছকে ১:৩ অনুপাতে প্রজন পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। প্রজননকালে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হলে ভালো হয়। তবে বৃষ্টিপাত কম হলে প্রতিদিন পুকুরে কমপক্ষে ২/১ ঘন্টা নলকূপের পানি সরবরাহ করতে হবে। হরমোন প্রয়োগের পর ৩-৫ দিনের মধ্যে প্রজনন ক্রিয়ার মাধ্যমে সাসট্রেট এর উপর চিতল মাছ ডিম দিয়ে থাকে। মাছের পরিপক্কতা ভেদে হরমোন ইনজেকশন প্রদানের পর ডিম ছাড়তে ৬-৭ দিনও লাগতে পারে।
                            
                            নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ এবং পরিচর্যা :
                            
                            পুকুর থেকে সাসট্রেটসহ নিষিক্ত ডিম সংগ্রহপূর্বক তাৎক্ষণিকভাবে হ্যাচারিতে স্থানান্তর করতে হবে। হ্যাচারিতে সিমেন্টের সিস্টার্নে স্থাপন করা গ্লাস নাইলনের হাপায় সাসট্রেটসহ ডিম ফোটার জন্য রাখতে হবে। পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ঝর্ণার ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক। এছাড়া পৃথক একটি ০.৫ ইঞ্চি আকারের পাইপ দিয়ে পানির অতিরিক্ত প্রবাহ দিতে হবে। নিষিক্ত ডিমের রং হালকা হলুদ বর্ণ হয়ে থাকে এবং তা ধীরে ধীরে হালকা লাল বর্ণ ধারণ করে এবং নিষিক্ত না হলে ডিমের রং সাদা হয়ে থাকে। নিষিক্ত হয়োর ৪-৫ দিনের মধ্যে ডিম ফোটে রেণু পোনা বের হয়ে আসে। তাপমাত্রা এবং পানির প্রবাহ সঠিকভাবে থাকলে হ্যাচিং হতে সময় অপেক্ষাকৃত কম লাগে।
                            
                            ডিম্বথলি যথেষ্ট বড় থাকার কারণে রেণু পোনাগুলো প্রাথমিকভাবে খুব ভালোভাবে নাড়াচড়া করতে পারে না, তবে ৫-৭ দিনের মাধ্যে বিভিন্ন আশ্রয়ের নীচে চলে যায়। তাই রেণু পোনার আশ্রয়ের জন্য মাঝারি আকারের কয়েক টুকরা ইট বিভিন্ন কোণায় এবং মাঝে দিতে হয়। শুকনো নারিকেলের পাতাও হাপার মধ্যে রেণু পোনার আশ্রয় হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ডিম ফোটার পর ডিমের খোলস, নষ্ট ডিম, মৃত পোনা ইত্যাদি রাবারের নল দিয়ে সাইফনিং করে ফেলে দিয়ে হাপা পরিষ্কার রাখতে হয়। ডিম্বথলি পরিপূর্ণ নিঃশেষিত হতে ১৩-১৪ দিন সময় লাগে। হাপায় পানির প্রবাহ সব সময় সঠিক রাখতে হয়।
                            
                            ট্রেতে রেণু পোনার পরিচর্যা :
                            
                            ডিম্বথলি নিঃশেষিত হওয়ার ১-২ দিন পূর্বে রেণু পোনাগুলোকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ট্রেতে কমপক্ষে ১৭-১৮ সেমি. (৭ ইঞ্চি) গভীর পানিতে স্থানান্তর করতে হবে। ট্রেতেও রেণু পোনার জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে এবং পানির গুণাগুণ সঠিক রাখার জন্য ট্রেতে সার্বক্ষণিকভাবে ঝর্ণা প্রবাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ সময় ট্রেতে রেণুগুলো বিভিন্ন আশ্রয় বা ট্রের কোণায় দলবদ্ধভাবে মাথা নীচের দিকে দিয়ে শুধুমাত্র লেজ নাড়াতে থাকে। ট্রেতে স্থানান্তরের পরপরই অর্থাৎ ডিম্বথলি নিঃশেষিত হওয়ার ১-২ দিন পূর্বেই রেণুপোনাকে খাদ্য হিসেবে মুরগীর সিদ্ধ ডিমের কুসুম ছেকে দুধের মতো তরল করে সরবরাহ করতে হবে। প্রথম ৪-৫ দিন প্রতিদিন কমপক্ষে ৩-৪ বার ট্রেতে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে । পরে মুরগীর ডিমের কুসুমের পাশাপাশি কুচিকুচি করে কাটা টিউবিফেক্স, সদ্য প্রস্ফুটিত রাজপুঁটি মাছের রেণু চিতল । রেণু পোনার খাদ্য হিসেবে দিতে হবে। খাবার প্রয়োগের সময় কমপক্ষে ৩০ মিনিট ঝর্ণার প্রবাহ বন্ধ রাখতে হবে এবং প্রতিবার খাদ্য প্রয়োগের ১ ঘন্টা পর সাইফনিং করে পরিত্যক্ত খাদ্য সরিয়ে ফেলতে হবে। এভাবে ১৮-২০ দিন বয়স পর্যন্ত চিতল মাছের রেণুকে পরিচর্যা করতে হবে।
                            
                            নার্সারি পুকুরে হাপায় পোনা স্থানান্তর : রেণু পোনার বয়স ১৮-২০ দিন হওয়া পর্যন্ত ট্রেতে পালনের পর সতর্কতার সাথে
                            
                            পুকুরে স্থাপিত নার্সিং হাপাতে স্থানান্তর করতে হবে। চিতল মাছের রেণু দলবদ্ধভাবে এক জায়গাতে জড়াজড়ি করে থাকতে পছন্দ করে বিধায় মজুদ ঘনত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। তথাপি অক্সিজেনের সঠিক প্রাপ্যতা রক্ষার্থে ৯-১২ শতাংশের পুকুরে ২.৫-৩.৫ ঘনমিটারের আকারের হাপা স্থাপন করে তার মধ্যে রেণু পোনা মজুদ করতে হয় হাপাতে রেণু পোনাগুলোকে ১ মাস বা পোনার আকার ২-৩ ইঞ্চি না হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করতে হবে। হাপাতে রেণু পোনার জন্য পর্যাপ্ত জুপ্লাংটন, তেলাপিয়া মাছের ডিম এবং মাছের মুখের আকারের চেয়ে ছোট যে কোন মাছের জীবিত রেণু পোনা সরবরাহ করতে হবে। হাপার মধ্যে পানির গুণাগুণ সঠিক রাখার জন্য কমপক্ষে ১০ দিন অন্তর অন্তর হাপার গায়ে লেগে থাকা শেওলা পরিষ্কার করে দিতে হবে। এভাবে প্রতিপালনের পর পোনাকে নার্সারি পুকুরে স্থানান্তর করতে হয়। নার্সারি পুকুর অন্যান্য মাছের রেণু চাষের মত চুন, সার ও সুমিথিয়ন প্রয়োগের মাধ্যমে প্রস্তুত করে চিতল মাছের পোনার খাদ্য নিশ্চিতকরণের জন্য যে কোন মাছের রেণু পোনা অধিক ঘণত্বে মজুদ করতে হবে। রেণু পোনার (চিতলের পোনার খাদ্য) বাঁচার হার নিশ্চিতকরণের জন্য এ সময় পুকুরে রেণুর জন্য সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। চিতল মাছের পোনা বিক্রয় উপযোগী না হওয়া (৩-৪ ইঞ্চি) পর্যন্ত নার্সারি পুকুরেই লালন-পালন করতে হবে।
কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ।
                   মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি 
সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।
                    
মৎস্য বাংলাদেশ ওয়েব সাইটির সাথে থাকতে ই-মেইল ঠিকানা লিখুন।
স্বত্ব © ২০২১-২২ মৎস্য বাংলাদেশ সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত।